সোনায় মোড়ানো "তাঞ্জোর" চিত্রকলা!

দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যেসব চিত্রকলা রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধশালী এবং ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা হল তাঞ্জোর চিত্রকলা। তামিলনাড়ুর দক্ষিণ রাজ্যে তাঞ্জাভুর শহরে এই চিত্রকলার জন্ম হয়েছিল। উৎপত্তিস্থল এর নামানুসারে এই চিত্রকলার নাম দেওয়া হয়েছিল। যদিও এই চিত্রকলা তাঞ্জাভুর চিত্রকলা নামেও খ্যাত। এই চিত্রকলা ষোড়শ শতাব্দী থেকে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং চোলা সম্রাটদের শাসনকালে চিত্রিত হয়েছিল এবং চিত্রশিল্পে সোনা ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত। যখন মারাঠারা তামিলনাডুর তাঞ্জোর আক্রমন করে তখন অনেক চিত্রশিল্পী এবং শিল্পী এখানে এসে বসবাস করা শুরু করেন এবং তাদের শাসনকালে এই শিল্পকলা বিস্তার লাভ করে।
এই চিত্রকলাকে 'সোনালী তাঞ্জোর' ও বলা চলে। কারন চিত্রকলা যখন সত্যিই দামি হয়...মূল্যবান হয়...তখনই নাম আসে এই তাঞ্জোর চিত্রকলার ! সোনা সহ আরো নানান মূল্যবান পাথর এই চিত্রকলায় ব্যবহার করা হতো। আর সমগ্র ভারতে এই চিত্রকলার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল এতে ব্যবহৃত উজ্জ্বল রঙ, জটিল বিবরণ এবং সোনার ব্যবহার।

কিন্তু, এই তাঞ্জোর চিত্রকলা আসলে কি? কেমন হয় এই তাঞ্জোর চিত্রকলা? সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক...

তাঞ্জোর চিত্রকলাগুলি সম্পূর্ন নিজের হাতে আঁকা হয়ে থাকে। কোনোরকম যন্ত্রপাতির ব্যবহার বা কৃত্রিমতা এখানে চোখে পড়ে না। তাঞ্জোর চিত্রকলা বানাতে, প্রথমে একটি কাপড়ের ওপর চিত্রকরেরা মনমতন একটি নকশা বানান। তারপর নকশা আঁকা সেই কাপড়টিকে একটি কাঠের তক্তার উপর লাগানো হয়। এই কাঠের তক্তা আসলে তৈরি করা হয় কাঁঠাল গাছ থেকে। তবে বর্তমানে এই তক্তার বদলে প্লাইউড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 
এরপর, গাঢ় বাদামি বা কালো রঙ দিয়ে নক্সাটির আউটলাইন আঁকা হয় এবং উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করে রঙ করা হয়।

এই চিত্রকলার ক্ষেত্রে কারিগরকে হতে হয় অত্যন্ত দক্ষ মানের। কারণ এতে ব্যবহৃত হয় মূল্যবান সোনা। এই সোনার ব্যবহার চিত্রকলাটিকে আরো প্রাণবন্ত করে এবং গভীরতা দান করে।

আগেকার সময়ে, এই চিত্রকলায় শাকসব্জী বা খনিজ পদার্থের রঙ ব্যবহৃত হত। যেমন, পশ্চাদপট সাধারণত লাল বা সবুজ হত, ভগবান বিষ্ণুর রঙ নীল এবং নটরাজের রঙ সাদা করা হত,দেবীদের রঙ করতে হলুদ রঙ ব্যবহৃত হত,আকাশের রঙ নীল বা কালো করা হত,দেব দেবীদের পোশাক পরিচ্ছদ এবং অলঙ্কার খাঁটি সোনা দিয়ে করা হত। আসলে, চিত্রের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মূলত রঙ বাছাই করা হতো।
সোনা, রত্নপাথর, মুক্তো, সোনার পাত, কাচের পুঁতি, এবং মূল্যবান পাথর চিত্রশিল্পের ওপর বসানো হত।  

খাঁটি সোনার ব্যবহার চিত্রকলাটিকে একটি অতুলনীয় চাক্ষুষ সৌন্দর্য্য প্রদান করত। যেহেতু প্রচুর পরিমাণে সোনা ব্যবহার করা হত, তাই এই চিত্রকলাগুলিকে একটি সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা হত। এই চিত্রকলাগুলির ঔজ্জ্বল্য প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী হত, যেহেতু খাঁটি সোনার উজ্জ্বলতা সহজে ম্লান হয়না। 

ননী হাতে ছোট্ট কৃষ্ণ (সোর্স:গুগল)

বিষয়বস্তু হিসেবে প্রত্যেকটি চিত্রকলা এক একটি কাহিনি কে বিবৃত করে। জানা যায় যে, তাঞ্জোর চিত্রশিল্পীদের সবথেকে-পছন্দের বিষয়বস্তু ছিল সোনার সিংহাসনে হাতে একটি ননীর পাত্র নিয়ে বসে থাকা ছোট্ট কৃষ্ণের মূর্তি। এছাড়া, তারা প্রায়ই হিন্দু দেবতা, পৌরাণিক দৃশ্য এবং অন্যান্য ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক থিম চিত্রিত করে। তাঞ্জো চিত্রকলাগুলি অনেক মন্দিরের দেয়ালে শোভা পায়, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে।

তাঞ্জোর চিত্রকলা যে কেবলমাত্র সুন্দর আর ঐতিহ্যবাহী তা কিন্তু নয়। এই চিত্রকলা দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতির ওপর দারুন ভাবে প্রভাব ফেলেছে। এছাড়াও, এই চিত্রকলা পর্যটকদের জন্যেও এক উল্লেখযোগ্য আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে, যা ভারতীয় চিত্রকলাকে আরো জনপ্রিয় করে তুলছে। 

যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলেছে। ঐতিহ্যবাহী তাঞ্জোরও চেষ্টা করছে সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। তাঞ্জোর চেষ্টা করছে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটা সেতু তৈরী করে দেওয়ার নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে...

  তবে, তাঞ্জোর চিত্রকলা আকাশ সমান নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে। উদাহরণস্বরূপ - ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারির দেয়াল সাজানো রয়েছে তাঞ্জোর চিত্রকলায়। এছাড়াও, তামিলনাড়ুর ঐতিহাসিক তাঞ্জাভুর আর্ট গ্যালারিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বস্তু, ভাস্কর্য, হিন্দু দেব-দেবীর চিত্রকর্ম এবং চোল এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের সময়কার শিল্পকর্ম রয়েছে। এই সময়কালে দক্ষ তাঞ্জোর কারিগরদের দ্বারা অতীতে তৈরি করা কিছু দুর্দান্ত তাঞ্জোর চিত্রকর্মও রয়েছে। অন্যতম ভাবে উল্লেখযোগ্য নয়াদিল্লির জাতীয় জাদুঘর ভারতের রাজধানী শহরের ন্যাশনাল মিউজিয়ামেও তাঞ্জোর পেইন্টিংয়ের একটি বিস্ময়কর সংগ্রহ রয়েছে।

অর্থাৎ এই যে, সোনায় মোড়ানো তাঞ্জোর এর অপূর্ব সৌন্দর্যতা এখনো ম্লান হয়নি...এখনও ভারতের সংস্কৃতিতে জ্বল জ্বল করছে তামিলনাড়ুর সোনায় মোড়ানো তাঞ্জোর...

Comments

  1. Very informative

    ReplyDelete
  2. হরে কৃষ্ণ, ভালো হয়েছে বেটা।

    ReplyDelete
  3. Khub valo hoyeche

    ReplyDelete
  4. keep up the good work

    ReplyDelete
  5. Shundor hoiche❤❤

    ReplyDelete
  6. "Pietra Dura" art work niye lekha porar abedon roilo..❤️

    ReplyDelete
  7. সুন্দর

    ReplyDelete
  8. অনেক কিছু জানতে পারলাম

    ReplyDelete
  9. অনেক কিছু জানতে পারলাম

    ReplyDelete
  10. Bhalo hoyeche lekhata...... Pore valo laglo..... 🙌

    ReplyDelete
  11. বাহ, চমৎকার ♥️

    ReplyDelete
  12. Lekha ta khub sundor bishesh kore choni ta ♥

    ReplyDelete
  13. Sorry chobi hobe typing mistake

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

তালপাতার "মিনিয়েচার" !

ছেঁড়া ফুল নয়, ঝরে যাওয়া ফুলের "মধুবনী"!