চিত্রকলা নয়, চিত্রকথা ''ওয়ারলি"!

ভারত একটি বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। যেখানে রয়েছে অগুনতি জাতি-উপজাতি, সংষ্কৃতি। হিমালয়ের পর্বত চূড়া থেকে সমুদ্রের জলবিন্দু অব্দি - এই বিশাল উপমহাদেশের প্রতিটি কোনে রয়েছে ঐতিহ্য, ভাষা, রীতিনীতি, বিশ্বাসের এক অনন্য সংমিশ্রণ। সেরকমই একটি ঐতিহ্যপূর্ন আদিবাসী উপজাতি হলো "ওয়ারলি"।এই "ওয়ারলি চিত্রকলা" মূলত ওয়ারলি আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাত ধরেই ভারতে এসেছে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই চিত্রশিল্পটি সবচেয়ে প্রাচীন চিত্রকলা হিসেবে পরিচিত। 
ভারতের পশ্চিমি দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য "মহারাষ্ট্রে" এর প্রথম উদ্ভব হয়। যদিও গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানেও এই সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। 
এ এক স্বতন্ত্র চিত্রকলা। যে কিনা নিজস্ব সৃজনশীল উপায়ে অনন্য ! সে হল "ওয়ারলি চিত্রকলা"। ভারতীয় চিত্রকলার এই অনবদ্য সংকলন নিয়েই আজকের এই ব্লগ।

ওয়ারলি চিত্রকলায় উৎপত্তির সময়কাল হিসেবে ঐতিহাসিকরা ১০ম শতককেই বেছে নিয়েছেন নানান নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে। তবে জানা যায় যে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই চিত্রকলাটি মানুষের চোখের আড়ালে ছিলো।

মূলত, ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপকূলীয় অঞ্চল অর্থাৎ দাহনু, তালাশারি, জওহর, পালঘাট, মোখাণ্ডা এবং বিক্রমগড় অঞ্চল জুড়ে এই ওয়ারলি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসস্থান। কিন্তু, ওয়ারলি জন্ম নিয়েছে মহারাষ্ট্রেই। ওয়ারলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারনত নিজেদের প্রাত্যহিক জীবন, কৃষিকাজ,ভিটে-মাটি, উৎসব কেই ওয়ারলি চিত্রকলাতে ফুটিয়ে তোলে। এগুলি ছাড়াও এই চিত্রকলাতে স্থান নিয়েছে নানান পৌরাণিক কাহিনী, লোককথা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামো। 
ওয়ারলি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে কিন্তু তার কোনো লিখিত রূপ নেই। সেই জন্যই এই চিত্রকলার মাধ্যমে তারা তাদের মনের ভাবকে ব্যক্ত করে। মূলত মহিলাদের হাতেই ফুঁটে ওঠে এই চিত্রকলা, যেগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই একটা চেনা ছন্দ চোখে পরে।
ওয়ারলিতে "বিবাহ" (সোর্স:গুগল)

ইট-মাটির ভিটেকে আরো সুন্দর করে তোলার জন্য মূলত এই ধরনের চিত্রগুলি আঁকা হত। কিভাবে আঁকা হতো সেই নিয়ে একটু জানা যাক...

ইটের দেওয়ালে লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়ে জল, আটা ও চালের গুঁড়োকে একসাথে মিশিয়ে, বাঁশ গাছের কাঠের তৈরি তুলিকে ব্যবহার করে গৃহবধূরা সুনিপুন হাতে এই চিত্রকলা আঁকেন। নানারকম উৎসব কে কেন্দ্র করেই মূলত আঁকা হয়ে থাকে এই চিত্রকলা। এই ধরনের চিত্রকলা গুলিকে একটু ভালো করে পর্যবেক্ষন করলেই আমরা দেখতে পারি এখানে বৃত্ত, ত্রিভুজআয়তক্ষেত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই জ্যামিতিক আকার গুলি কিছু নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক উপাদান কে চিহ্নিত করে। যেমন, বৃত্ত বর্ণনা করে সূর্য কিংবা চাঁদ কে। অন্যদিকে, ত্রিভুজ পাহাড়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং আয়তক্ষেত্র হলো পেইন্টিংয়ের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যে বা চাষাবাদ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও রয়েছে সরলরেখা, বক্ররেখা, বিন্দুর মতন আরো নানান মৌলিক আকার।

যেমন, একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক...

যদি কোনো মানুষকে আমরা ওয়ারলি চিত্রকলার উপায়ে আঁকতে যাই তাহলে আমরা দুটি ত্রিভুজকে উপর-নীচে বসিয়ে ফিগার এবং হাত পা হিসেবে সরলরেখাকে ব্যবহার করতে পারি। তেমনই, একটি ঘর আঁকতে গেলে আমরা ত্রিভুজ ও আয়তক্ষেত্রের সাহায্যে আঁকতে পারি। এরকম আরো অনেক উদাহরনই রয়েছে।

তবে, ওয়ারলি চিত্রকলার ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ রয়েছে যেমন-

১. প্রথমে পুরো ছবির একটি পরিকল্পনা করতে হয়।

২. দেয়াল, কাপড়, কাগজ অর্থাৎ যেখানে ছবিটা আঁকা হবে সেটি আদেও মানানসই কিনা, সেই বিষয়েও ভাবতে হবে।

৩. ছবি আঁকার জন্য নানান সরঞ্জাম যেমন চালের গুঁড়ো ইত্যাদি জোগাড় করা। এছাড়াও, বাঁশের কঞ্চিকে থেতলে তুলি বানানো ইত্যাদি জোগাড় করতে হয়।

৪.  এই চিত্রকলা সাধারনত সাদা রং দিয়ে করা হয়, অন্যান্য রঙের প্রয়োগ করা হয়না।

৫. অন্যান্য বিষয় আঁকার আগে ফিগারগুলি এঁকে নিতে হয়।

৬. প্রথমে করে নেয়া ড্রইং অনুযায়ী ছবিতে নানা প্রাকৃতিক উপাদান যেমন গাছপালা, পশু-পাখী, ফুল-পাতা ইত্যাদি চিত্রিত করা হয়।

ওয়ারলি চিত্রকলা কে "চিত্রকথা" বললেও কিন্তু ভুল কিছু বলা হবেনা। কারন, আমরা আগেই জেনেছি যে ওয়ারলি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজস্ব ভাষা ছিলো যার কোনো লিখিত রূপ ছিলনা। এই অঙ্কন পদ্ধতির দ্বারাই তারা প্রবহমান জীবনধারাকে তুলে ধরে, তাই বলা চলে যে ওয়ারলি চিত্রকলায় ছবি কথা বলে। এছাড়াও, পরের প্রজন্মকে শিক্ষা দান করা, বিভিন্ন কাহিনী সম্পর্কে অবগত করা, বংশ পরম্পরার বিষয়ে জানানো ইত্যাদি...এইসব বিষয়ও তারা তুলে ধরে।

ওয়ারলি সম্প্রদায় এই চিত্রকলাকে কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যেই বেঁধে রাখেনি। এই চিত্রকলার মাধ্যমে তারা সমাজকেও অনেক কিছু জানান দিয়েছে। যেমন মাঠে কৃষিকাজ হচ্ছে, বা তারা প্রকৃতির সাথে বসবাস করে, তাকে নষ্ট করেনা, এরকম অর্নিদিষ্ট বিষয়। চিত্রকলার মধ্যে গল্প বলাটা এখানে বুঝতে হবে। এখানে কৃষক আছে কিন্তু কোন নির্দিষ্ট কৃষক নয়, গরু আছে সে কোন নির্দিষ্ট গরু নয়, তারা হলো প্রত্যেকদিনের জীবনের সাধারণ চরিত্র মাত্র। পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়া যে - আমরা একসাথে থাকি, একসাথে নাচি, একসাথে বাঁচি...আমরা প্রকৃতিকে ভালবাসি! ওয়ারলি চিত্রকলাকে উদ্দেশ্যে করে আজ কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা একটা কবিতা বড্ড মনে পড়ছে, সেটা হলো....

"পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি"।
 



Comments

  1. khub bhalo laglo jante pere ei art form tar byapare, etodin anek dekhechi tobe aaj anekta jante parlam er byapare...

    ReplyDelete
  2. Khub Sundor hoyeche ❤️

    ReplyDelete
  3. The design and layout of your blog are just as impressive as your content. It's a pleasure to navigate

    ReplyDelete
  4. Your blog is a breath of fresh air in a crowded online space. It's always a joy to read."

    ReplyDelete
  5. I always leave your blog feeling more informed and inspired

    ReplyDelete
  6. মিষ্টি হয়েছে লেখাটা❤️

    ReplyDelete
  7. Valo hoyeche chaliye ja

    ReplyDelete
  8. Writing skills valoi kaje laga seta

    ReplyDelete
  9. শেষে কবিতা দিয়ে ভালো করেছিস বুনু, বেশ ভালো হয়েছে লেখাটা ♥️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সোনায় মোড়ানো "তাঞ্জোর" চিত্রকলা!

তালপাতার "মিনিয়েচার" !

ছেঁড়া ফুল নয়, ঝরে যাওয়া ফুলের "মধুবনী"!