রঙবেরঙের "কলমকারি" !

কলমকারি নামটা কিন্তু আমাদের কাছে খুব একটা অচেনা নয়। কারণ, বর্তমান দিনে দাঁড়িয়ে "কলমকারি" শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে হাতে আঁকা বা ব্লক মুদ্রিত কটন শাড়ির কথা যা ভারত এবং ইরানের কিছু অংশে তৈরি করা হয়। কিন্তু, কেবলমাত্র শাড়িতেই এই কলমকারি সীমিত নয়।

ভারতের সেই প্রাচীন কাল থেকে বহু ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা প্রচলিত রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম তথা জনপ্রিয় চিত্রকলা হলো "কলমকারি" চিত্রকলা। তবে, এর পেছনেও কম ইতিহাস লুকিয়ে নেই। সেই অজানা ইতিহাস কে নিয়েই আজকে আলোচনা করবো।

কথাতেই আছে "কলমকারি"। একটু সন্ধি বিচ্ছেদ করলেই এই চিত্রকলার প্রকৃত অর্থ আমরা সহজেই বুঝতে পারবো। কলমকারি অর্থাৎ কলম+কারি। কলম মানে হলো পেন, আর কারি অর্থে এখানে কারিগরকে বোঝানো হয়েছে। পুরো অর্থ হলো, কারিগর বা শিল্পীর দ্বারা আঁকা কলমের শিল্পকর্ম। এছাড়াও, কলমশিল্প বা কলমকাজও বলা চলে। আদতে কিন্তু তাই বোঝায়। সে বিষয়ে একটু আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।

জানা যায় যে, এই কলমকারি চিত্রকলার উৎপত্তি তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশে প্রায় কয়েকশো বছর আগে হয়েছে। কিন্তু, এই বিশেষ চিত্রকলা বিশ্বের সামনে আসতেই পারতোনা যদিনা "চিত্রকূট" নামের এক বিশেষ জাতি এই চিত্রকলার চিন্তাধারা না করতো। এই ধরনের জাতির লোকেদের লোকশিল্প ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে রামায়ন, মহাভারত সহ হিন্দু দেবদেবীর নানান পৌরাণিক কাহিনীগুলিকে যাত্রা, নাটক ও গানের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা। এদের মধ্যে অনেক গায়ক থেকে শুরু করে চিত্রকর অব্দি, সবাই থাকতেন। নিজেদের কাজে নতুনত্ব আনার জন্য তারা এক নতুন ধরনের শৈলীর আবিষ্কার করেন। নাটককে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য তারা একটা বড়ো কাপড়ে নিজেদের কাহিনীগুলিকে চিত্রের আকারে ফুঁটিয়ে তুলতেন। তখনই প্রথম আলো দেখে কলমকারি চিত্রকলা। হিন্দু দেবদেবীর এত সুন্দর নিদর্শনকে পরবর্তীকালে অনেক বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি পরবর্তীকালে নানান মন্দিরের আলংকারিক পটভূমিতে এই রঙবেরঙের কলমকারি নানান দেবতাদের গল্প ফুটিয়ে তোলে।

কিন্তু, মুঘল যুগেই এই চিত্রকলা নিজের স্বীকৃতি লাভ করে। মুঘলরা গোলকুন্ডা এবং করোমন্ডেল প্রদেশে এই শিল্পের প্রচার করেছিল যেখানে দক্ষ কারিগররা (কুয়ালামকার নামে পরিচিত) এই শিল্পটি অনুশীলন করতেন, এভাবেই এই শিল্প এবং কলমকারি শব্দটি বিকশিত হয়েছিল।
কলমকারির কলমে "ময়ূরপঙ্খী" (সোর্স:গুগল)

একটি কলমকারি চিত্রকলা মোট ২৩টি ধাপে তৈরি করা হয়। আমরা সেবিষয়ে জেনে নেবো...

প্রথমে কলমকারির জন্য ব্যবহৃত সুতির কাপড় কে গোবর এবং ব্লিচ মেশানো জলে ভালো করে চোবানো হয়। এই দ্রবণে ফেব্রিকটিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাখার পর, ফেব্রিকটি একটি অভিন্ন অফ-হোয়াইট রঙ পায়। এর পরে, সুতির কাপড়টি মহিষের দুধ এবং মাইরোবালানের মিশ্রণে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। পরে, মহিষের দুধের গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে কাপড়টি জলে ভালো করে ধুয়ে ফেলা হয়। এরমই, একইভাবে ফেব্রিকটি প্রায় ২০ বার জলে ধোওয়া হয়, এবং তার পরেই সূর্যের তাপে রোদে শুকোতে দেওয়া হয়। একবার আঁকার জন্য কাপড়টি প্রস্তুত হয়ে গেলে, শিল্পীরা ফেব্রিকের উপর নিজেদের মন মতন  নকশা, স্কেচ, বা ডিজাইন তৈরি করেন। এটির পরে, কলমকারি শিল্পীরা আঁকার মধ্যে রঙ প্রদান করেন।

কলমকারি শিল্পে প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ঠ উদ্ভিজ্জ রঙ ব্যবহার করা হয় কোনোরকম রাসায়নিক এবং কৃত্রিম পদার্থ মিশ্রণের ছাড়াই। যেমন নীল, সরিষা, মরিচা, কালো এবং সবুজের মতো মাটির রং ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কারিগররা গুড়, জল এবং লোহার মরিচা মিশিয়ে কালো রঙ বের করে যা তারা মূলত স্কেচের আউটলাইনের জন্য ব্যবহার করে। আর, মূল কথা হলো এই যে এই কলমকারি চিত্রকলা তে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে এই আউটলাইন। কারণ, চিত্রকরেরা প্রথমেই কাপড়ে আউটলাইন তৈরি করেন, তারপরেই সেখানে রঙ দিয়ে ভরিয়ে দেন। এছাড়াও, ডালিমের খোসা সিদ্ধ করে হলুদ রঙ, নীল থেকে নীল এবং হলুদ ও নীলকে একসাথে মিশিয়ে সবুজ পাওয়া যায়।

কৃষ্ণ রাস-লীলা, ভারতীয় দেবতা এবং পার্বতী, বিষ্ণু, শ্রী জগন্নাথের মতো দেবদেবীদের সুন্দর ভাবে আঁকার জন্য কলমকাররা কলম হিসাবে 'তেঁতুলের ডাল' ব্যবহার করেন এছাড়াও তারা বাঁশ গাছের ডাল ব্যবহার করে থাকেন।

ওই ডালের মাথার অংশের দিকে কটনের কাপড় পেঁচিয়ে নেওয়া হয়। তারপর রঙে ডোবানো হয়। রঙকে কাপড় শুষে নেওয়ার পর শিল্পীরা ওই ডাল দিয়ে রঙ করে থাকেন। রঙ করে শুকিয়ে নেওয়ার পর ওই কাপড়কে জলে আবার ধুঁয়ে নেন চিত্রকরেরা। এরপর এক বিশেষ রঞ্জক মিশ্রিত জলে কাপড়টিকে বারংবার ধুঁয়ে নেওয়া হয় যার ফলে কাপড়টি আরো মজবুত হয় এবং কাপড়ের উপর রঙ আরো গাঢ় হয়ে ওঠে। তারপর জল থেকে তুলে সেই কাপড়কে রোদে শুকনো হয়ে থাকে। এরম ৪০-৪৫ দিনের প্রচেষ্টা প্রয়াসের পর তৈরি হয় রঙবেরঙের কলমকারি। 

ভারতে দুই ধরনের কলমকারি প্রসিদ্ধ। একটি হলো মছিলিপত্তনম এবং আরেকটি হলো শ্রীকলাহস্তী
মছিলিপত্তনম এর ক্ষেত্রে সাধারণত ব্লক প্রিন্টিং ব্যবহার করা হয় এবং এটি কলমের দ্বারা চিত্রিত হয়। অন্যদিকে, শ্রীকলাহস্তী তুলে ধরে নানান ধার্মিক কাহিনী, যা ব্লকের সাহায্য ছাড়া হাতের মাধ্যমে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন।

প্রাচীনকাল থেকেই কলমকারি শিল্প ছিল বেশ কিছু গ্রামীণ মহিলা এবং কারিগরদের একটি গার্হস্থ্য পেশা এবং এটি এখনও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অব্দি চলে আসছে। ভারতীয় দেব-দেবীকে চিত্রিত করা থেকে শুরু করে মুঘল রাজত্বকালে স্বীকৃতি লাভের প্রক্রিয়া এবং এখনো অব্দি যখন অন্ধ্রপ্রদেশ কলমকারির বৃহত্তম উৎপাদনকারী; এতখানি দীর্ঘ পথ কলমকারি ইতিমধ্যে পেরিয়ে এসেছে।

এখনো পর্যন্ত অন্ধ্র প্রদেশের অনেক পরিবার এই শিল্পের অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে এবং এটি তাদের জন্য জীবিকার প্রধান উৎস। শুধু দেবদেবীর মধ্যেই কিন্তু কলমকারি আটকে নেই! শিল্পটি আরও বেশি জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে কলমকারি শিল্পীরা তাদের নকশাকে আধুনিকীকরণ করেছেন এবং আরও বেশি ধারণা এবং থিম নিয়ে এনেছেন। 

বিংশ শতাব্দীতে অন্ধ্র প্রদেশের শেষ জীবিত কলমকারি শিল্পীদের মধ্যে একজন ছিলেন লক্ষ্মাইয়া, যিনি এখনও মহাভারত এবং রামায়ণের মতো তাঁর মাস্টারপিসগুলির জন্য পরিচিত, যেগুলি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এবং অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সংগ্রহে রয়েছে। তাকেই অনুসরণ করে, তাঁর পুত্র এবং বংশধররাও কলমকারি শিল্পী হিসেবে উচ্চ পুরস্কৃত। বর্তমানে প্রায় 16 জন দক্ষ কলমকারি শিল্পী বেঁচে আছেন এবং কাজ করছেন, যাদের মধ্যে 10 জন জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন। 

বর্তমান দিনে দাঁড়িয়ে কলমকারি চিত্রকলা উৎপাদনের হার হয়তো অনেকটাই কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে আমরা এর দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ধরতে পারি। কিন্তু, কলমকারি হলো প্রজন্মের শিল্প। বছরের পর বছর এই রঙবেরঙের কলমকারি প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে বেঁচে রয়েছে, আর থাকবেও...

Comments

  1. চমৎকার

    ReplyDelete
  2. পরীকাঠামো খুব ভালো হয়েছে:)

    ReplyDelete
  3. Khub Sundor hoyeche ❤️

    ReplyDelete
  4. লিখতে থাকো🫂

    ReplyDelete
  5. Khub sundor hoyeche ♥️♥️

    ReplyDelete
  6. Sundor likhecho...❤️

    ReplyDelete
  7. very informative... glad to know all this!!!

    ReplyDelete
  8. Notun kichu jante parlam khub valo hoyeche lekha ta❤️❤️

    ReplyDelete
  9. very good keep it up

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সোনায় মোড়ানো "তাঞ্জোর" চিত্রকলা!

তালপাতার "মিনিয়েচার" !

ছেঁড়া ফুল নয়, ঝরে যাওয়া ফুলের "মধুবনী"!