ছেঁড়া ফুল নয়, ঝরে যাওয়া ফুলের "মধুবনী"!

।। যখন বিষন্ন হয় মন, শ্বাসরুদ্ধকর শহরে, ছুটে চলে যাই তুলিতে আঁকা গ্রাম গোলাবাড়ির কোনে ।।

  এই একঘেয়েমিতে ভরা শহরে যখন একদমই মন টেকে না, তখন মনে হয় যে ছুটে চলে যায় কোনো এক জায়গায় যেখানে শান্তির আভাস পাওয়া যাবে। এই ব্যস্ত যানজটময় শহরে বড্ড দম বন্ধকর পরিবেশের হাত থেকে বাচঁতে মাঝে মাঝে সবুজ শীতলময় গ্রামের স্নিগ্ধ বাতাস অনুভব করতে ইচ্ছে করে। সেরকমই একটি জায়গার কথা আজকে তুলে ধরবো যেখানে গ্রামের প্রত্যেকটি দেওয়াল, প্রত্যেকটি কুঁড়েঘর তুলি দিয়ে আঁকা। আজ বলবো সীতা মায়ের জন্মস্থান "মিথিলার" মধুবনী চিত্রকলা নিয়ে। যে চিত্রকলায় ঢেকে থাকে গ্রামের  দেওয়াল, আঙিনা গুলো।

ভারতীয় সংস্কৃতি নানান চিত্রকলা তে আচ্ছন্ন, সেগুলির মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো এই মধুবনী চিত্ৰকলা। বিহারের মিথিলা এবং নেপালের কিছু অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যেবাহী পরিচয় হলো এই মধুবনী পেইন্টিং। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন আর্ট ফেস্ট হয়তো খুব কমই দেখা যায় যেখানে হয়তো এই মধুবনী আর্ট চোখে পড়েনা। বিহার থেকে যাত্রা শুরু করলেও এই মধুবনী আর্ট এখন এখন পা দিয়েছে জাপান পর্যন্ত। জাপানের এক জাদুঘরে এই মধুবনী চিত্রকলা প্রদর্শিত হয়েছে।তবে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায় এমন অনেক কিছু তথ্য যা জানান দেয় যে এই মধুবনী চিত্রকলা হল এক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি।

জানা যায় যে, মা সীতা ও রামের বিবাহের সময় জনক রাজা মিথিলার মহিলাদের ঘরের দেওয়াল ও আঙ্গনকে মধুবনী চিত্রকলায় ফুঁটিয়ে তুলতে বলেছিলেন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন এই চিত্রকলার মাধ্যমে মিথিলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে। তবে, ১৯৫০ সাল অব্দি এটি লোকশিল্প ছিল। হয়তো এটি বিশ্বব্যাপী পরিচয় পেত না যদি না ব্রিটিশ অফিসার উইলিয়াম আর্চার এর চোখে এই চিত্রকলা ধরা না দিতো।

১৯৩৪ সালে ভারত-নেপাল সীমান্তে একটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়, যার ফলে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।সেই সময়ে ঐ অঞ্চলের ব্রিটিশ অফিসার উইলিয়াম আর্চার ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা দেখতে এসে ভাঙা দেয়ালে মধুবনী চিত্রকলার সন্ধান পান, এসব দেয়াল চিত্র দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে অনেক ছবি তুলেছিলেন, যেগুলিকে এখনো পর্যন্ত মধুবনী চিত্রকলার সবচেয়ে পুরোনো ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়। পরবর্তীকালে আর্চার ১৯৪৯ সালে একটি আর্টিকেল লেখেন যেখানে তিনি এই মধুবনী আর্ট কে মীরো এবং পিকাসোর সাথে তুলনা করেছিলেন। যার ফলে বিহারের মধুবনী চিত্রকলা বিশ্বব্যাপী পরিচয় অর্জন করে এবং ভারতবর্ষের লোকশিল্প "মধুবনী/মিথিলা" চিত্রকলা নিজের সুনাম অর্জন করে।
                  মধুবনীতে "রাধা-কৃষ্ণ''(সোর্স:গুগল)

অন্যান্য চিত্রকলার মত তুলির সাহায্যে এই আর্ট আঁকা হলেও এটির বিশেষত্ব হলো যে এটি আঁকার জন্য আঙ্গুল, দেশলাইয়ের কাঠি,তুলো নিব-কলম, প্রাকৃতিক রঙ রঞ্জক ব্যবহার করা হয়। এতে ব্যবহৃত উপকরণগুলো সাধারণত প্রকৃতি থেকে নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, লাল রঙের জন্য কাদামাটি এছাড়াও সিঁদুরের গুঁড়োর সাথে সরিষার বীজ মেশানো হয়, সবুজ এবং কালো রঙের জন্য বাতির কালোর সাথে গোবর মেশানো হয়, সাদা রঙের জন্য চালের পেস্ট,  নীলের জন্য অপরাজিতা ফুল,কমলার জন্য পলাশ ফুল, সবুজের জন্য বিল্ব পাতা। এছাড়াও ব্যবহার করা হতো চন্দন, গাছের পাতা, কাদা, গোবর প্রভৃতি। তবে, রং তৈরীর জন্য ফুল ছেঁড়া হয় না, ঝরে পড়া ফুল ব্যবহার করা হয়। আগে শিল্পীরা অতি যত্ন সহকারে রঙ তৈরি করতেন। বর্তমানে অবশ্য প্রযুক্তির খাতিরে নানা রকম রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি রঙ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও ব্যবহৃত হতো চালের গুঁড়ো, তেঁতুল এবং আরও নানা রকম ফল ও ফলের বিজ ফুলের রেনু, প্রাকৃতিক নীল, চন্দন কাঠ, বিভিন্ন ফুল ও গাছের পাতা, গাছের ছাল-বাকল, কচি ডাল ও লতা।

এই চিত্রকলা সাধারণত ঐতিহ্যগতভাবে ব্রাহ্মন ও কায়স্থ বর্ণের মহিলা সদস্যের দ্বারা অনুশীলন করা হত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই চিত্রকলা মহিলাদের দ্বারা চিত্রিত হয়ে আসছে। ১৯৬০-এর দশকে ভারত ও নেপালের 'উচ্চ বর্ণের' বিশেষ করে ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থ মহিলারা ভার্ণি, কাচনি এবং তান্ত্রিক শৈলীগুলো অঙ্কন করেছিল। তাদের বিষয়বস্তু ছিল মূলত ধর্মীয় এবং তারা ঈশ্বর ও দেবদেবীর চিত্র চিত্রিত করেছিল। নিম্ন বর্ণের লোকেরা তাদের চিত্রগুলোতে তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক এবং প্রতীক, রাজাদের গল্প এবং আরও অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তবে বর্তমানে মধুবনী শিল্পটি বিশ্বায়িত শিল্পে পরিণত হয়েছে, তাই বর্ণ ব্যবস্থার ভিত্তিতে কাজের কোনও পার্থক্য নেই। তারা প্রত্যেকেই পাঁচটি শৈলীতে কাজ করে। পাঁচটি শৈলী বলতে....কোহবার, ভরণী কাচনি, গোদনা, ও তান্ত্রিক।

কোহবার - মধুবনী চিত্রকলার কোহবার মিথিলা শিল্পের শৈলীর অন্যতম জনপ্রিয় রূপ। কোহবার একটি অত্যন্ত মূল্যবান শব্দ যখন আমরা মধুবনী শিল্পের কথা বলি কারণ এটি একটি হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কোহবার শিল্প তন্ত্ররাজ, যোগ যোগিনী এবং শিব শক্তি নামেও চলে, যার অর্থ ভগবান শিবের আশীর্বাদে শক্তি বাস করে। এই পেইন্টিংটি প্রধানত হিন্দু বিবাহের অনুষ্ঠানগুলিকে চিত্রিত করে এবং সেগুলি প্রাথমিকভাবে বর এবং কনের বাড়ির দেওয়ালে তৈরি করা হয়।

ভরণী - ভরনী শৈলী চিত্রকলা মধুবনী চিত্রকলার পাঁচটি শৈলীর একটি। এটি একটি খুব গভীর শিল্প ফর্ম যা তার প্রাণবন্ত এবং উজ্জ্বল রঙের জন্য পরিচিত। এই শিল্পের ফর্মটি ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু দেবতাদের এবং ভারতীয় পুরাণে তাদের ঐতিহাসিক অবদানগুলিকে চিত্রিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে। হিন্দিতে বারুনি মানে "ভর্তি"। নামটি রঙ এবং নকশায় পূর্ণ চিত্রকলার শৈলীকে প্রকাশ করে। ভার্নি পেইন্টিংয়ে সাধারণত হিন্দু দেব-দেবীর ছবি দেখানো হয়।

কাচনি - মধুবনী চিত্রকলার কাচনি চিত্রকলার শৈলী হল একটি ঐতিহ্যবাহী চিত্রশৈলী যা কায়স্থ সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। এই বিশেষ শিল্পের একটি অনন্য স্বতন্ত্র শৈলী রয়েছে, প্রধানত একটি একরঙা বা শুধুমাত্র দুটি রঙ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। পেইন্টিংয়ের এই শৈলীটি দর্শকদের আকর্ষণ করে কারণ তারা একটি সীমিত রঙের পরিসর সহ প্রাকৃতিক দিকগুলির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলিকে হাইলাইট করে। মধুবনী জেলার রান্টি গ্রামের ছোট শহর থেকে কাচিন পেইন্টিং শৈলী অনেক দূর এসেছে। ফর্মের পার্থক্যটি মূলত চিত্রগুলির লাইনওয়ার্কের মধ্যে দেখা যায়। এই চিত্রগুলি প্রাথমিকভাবে প্রাণী, ফুল এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দিকগুলিকে চিত্রিত করে।

গোদনা - মধুবনী শিল্পের পাঁচটি শৈলীর মধ্যে গোদনা রয়েছে। এই আর্ট ফর্মটি মিথিলা চিত্রকলার একটি অনন্য এবং সুন্দর শৈলী। মিথিলা শিল্প শৈলীর দৌড়ে গোডনা চিত্রকলার শৈলীকে সবচেয়ে সহজবোধ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গোদনা মধুবনী চিত্রকলার আবিষ্কারটি চানু দেবী করেছিলেন বলে মনে করা হয় যেখানে তিনি নকশা তৈরি করতে বাঁশ ও কাজলের তৈরি একটি কলম ব্যবহার করেছিলেন। এই শিল্পটি প্রাকৃতিক প্রাণী যেমন প্রাণী, পাখি, গাছপালা, জীবনের গাছ এবং ফুলকে স্পষ্টভাবে বোঝায়। এই পেইন্টিং শৈলীটি বিখ্যাতভাবে ক্যানভাসে করা হয়, তবে লোকেরা এগুলিকে ট্যাটু হিসাবেও ব্যবহার করে।

তান্ত্রিক - মিথিলা বা মধুবনী শিল্পের তান্ত্রিক চিত্রশৈলী চিত্রকলার একটি অত্যন্ত স্বতন্ত্র শৈলী। এই শৈলী ঐতিহ্যগত এবং ধর্মীয় গ্রন্থের একটি খুব সঠিক উপস্থাপনা. তন্ত্র একটি মূল পাঠ্য যা হিন্দু ধর্ম এবং এর দিকগুলি বর্ণনা করে। তাই, বেশিরভাগ তান্ত্রিক শৈলীর চিত্রকর্মের চিত্রকলার ধরণে তান্ত্রিক প্রভাব রয়েছে। এই চিত্রগুলি ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু পুরাণের চরিত্রগুলিকে চিত্রিত করে যা হিন্দুদের দৃঢ় বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। ভারতে লোকেরা সাধারণত দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে প্রার্থনার জন্য তাদের বাড়িতে বা কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে এই চিত্রগুলিকে জড়িত করে।

আগেই বলেছি যে, সাধারণত মহিলাদের দ্বারা এই চিত্রকলা নিদর্শন হয়ে আসছে। মহিলারা সাধারণত ঘর সাজানোর উদ্দেশ্য অর্থাৎ গৃহসজ্জার জন্য দেওয়ালে এই ছবিগুলো আলপনার মতন করে আঁকতেন। যার মাধ্যমে ওনারা নিজেদের চিন্তা, স্বপ্ন, জীবনদর্শন কে প্রতিফলিত করতেন। 
বিষয়বস্তু হিসেবে মধুবনী ছবি হিন্দু দেব-দেবীদের উপাখ্যানের উপর রচনা করা হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী যারা উপস্থিত তারা হলেন রাম-সীতা, কৃষ্ণ, লক্ষী, শিব, দূর্গা, সরস্বতি ইত্যাদি। তবে, সময়ের সাথে সাথে এই চিত্রকলা বিভিন্ন উৎসব ও বিবাহের মতন বিশেষ অনুষ্ঠানকেও বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে ধরেছে। বিবাহের পাশাপাশি দোলযাত্রা, উপনয়ন, কালীপূজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শুধুমাত্র হিন্দু মাইথলোজি তেই মধুবনী থেমে নেই। এই মধুবনী চিত্রকলা বিভিন্ন প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ যেমন প্রাণী, পাখি, গাছ, উদ্ভিদ ইত্যাদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেও ফুটিয়ে তোলা। এছাড়াও, গ্রামীন বিহারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, কৃষিকাজ, রান্না-উৎসব কেও ফুটিয়ে তোলে মধুবনীর তুলি।

তবে সকলেই আমরা জানি যে, একটি চিত্ররীতি একদিনে গড়ে ওঠেনা। বহু মানুষের বহু যুগের চর্চায় একটি লোকশিল্প ধারা সৃষ্টি হয়। যেমন উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন কার্পুরী দেবী , সীতা দেবী, জগদম্নবা দেবী, গঙ্গা দেবী, বাউয়া দেবী, মহাসুন্দরী দেবী এবং গদাবরী দত্ত। বেশ কয়েকজন মধুবনী শিল্পী ভারতের জাতীয় পুরস্কার পদ্মভূষণ, চন্দ্রভূষণ ইত্যাদি দ্বারা সম্মানীত হয়েছেন। এছাড়াও মধুবনী শিল্প ক্রমশ আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও বেশী আলোচিত হচ্ছে।

আজ হয়তো সেভাবে আর কুঁড়েঘর নেই, নেই পাঁকা মাটির ঘর। তবে চোখ রাখলে হয়তো আজও খুঁজে পাওয়া যাবে যে এখনোও হয়তো এমন কিছু শিল্পী রয়েছেন যারা নিজেদের ভাবনা-চিন্তা কে ফুটিয়ে তোলার জন্য তুলি হাতে মধুবনী কে এঁকে চলেছেন। এইভাবেই বছরের পর বছর এই 'মধুবনী' চিত্রকলা আজও বেঁচে রয়েছে, এবং আগামীতেও থাকবে...





Comments

  1. besh valo 🙌🏻

    ReplyDelete
  2. I’m always impressed by your writing. This blog post is no exception!

    ReplyDelete
  3. Thank you for sharing this! Your positive outlook is truly contagious

    ReplyDelete
  4. খুব সুন্দর হয়েছে ♥️💥

    ReplyDelete
  5. Khub sundor ❤️

    ReplyDelete
  6. Khub valo hoyeche

    ReplyDelete
  7. Khub valo hoyeche

    ReplyDelete
  8. ♥️♥️♥️

    ReplyDelete
  9. Title ta Sunda diyechish

    ReplyDelete
  10. Khub sundor r lekha tao khub vlo likhe6s ✨

    ReplyDelete
  11. Khub..e sundor hoyeche keep it up

    ReplyDelete
  12. Khub Sundor hoyeche ❤️

    ReplyDelete
  13. Thik jemon ta dorkar, temoni! Khub bhalo! ♥️

    ReplyDelete
  14. Khub sundor likhe6s

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সোনায় মোড়ানো "তাঞ্জোর" চিত্রকলা!

তালপাতার "মিনিয়েচার" !