পটচিত্র : রঙের ছোঁয়ায়, রঙ বাহারি !
ক্লাস টুয়েলভ এ বাঙালির চিত্রকলা তে পড়া "পটশিল্প"এর কথা মনে আছে তো? সংস্কৃত শব্দ "পট্ট" থেকেই পট কথাটির জন্ম, যার অর্থ হলো "কাপড়"। এই কাপড়ের ওপরই আটা, কাদা, গোবরের প্রলেপ দিয়েই প্রথমে জমিন তৈরি করা হয়। "পট" আমাদের কাছে সেভাবে অজানা নয়। কারণ, আমাদের বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ধারক এবং বাহক হলো এই "পটচিত্র" বা "পটশিল্প"। উড়িষ্যা এবং বাংলার এই গৌরবময় শিল্পকলা নিয়ে আমরা কম-বেশি সকলেই জানি। রাজস্থানের কিছু অঞ্চলেও পটচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তবে তা বাংলা বা উড়িষ্যার মতন সমৃদ্ধশালী নয়। প্রাচীন বাংলায় যখন কোন দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি তখন পটচিত্রই ছিল বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক।
কোলকাতা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা ব্লকের "নয়া গ্রাম" নিজের শিল্প মাধ্যম এবং ঐতিহ্যবাহী ধারণ ক্ষমতা নিয়ে আজ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিশ্বের দরবারে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে হয়তো এই একটা গ্রামই অবশিষ্ট রয়েছে যেখানে গেলে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। প্রত্যেকটি বাড়ির দেওয়ালে, উঠোনে এই কারুকার্য তারা ফুঁটিয়ে তুলেছে। এমনকি, ঘরের সামনে পটের পসরা সাজিয়ে, বসে বসে পট আঁকতে দেখা যায় পটুয়া দের। একটা আস্ত গ্রাম যে এতটা রঙিন হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়না। সেখানে বেশিরভাগই সবাই শিল্পী, সবাই পটুয়া। ওহ, পটুয়া নিয়েই তো বলা হলনা !
পটুয়া হলো, যারা পট কে রঙবেরঙের খেলায় মাতিয়ে তোলে। সেইসব শিল্পী, যারা একাধারে কবি,গায়ক ও চিত্রশিল্পী। রঙ থেকে মনে পড়লো পটচিত্রে ব্যবহৃত ভেষজ রঙের কথা।পটচিত্র অনেক জমজমাট ! কৃত্রিম রং নয় বরং প্রাকৃতিক রং দিয়ে তৈরি হয় এই রং বেরঙের চোখ ধাঁধানো "পট"। কিন্তু, প্রাকৃতিক রঙ বলতে? আসলে, পটের জন্য ব্যবহার করা হয় নানান ধরণের প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট রঙ। মাটি ও প্রকৃতি থেকে নেওয়া হয় রঙ। যেমন? ইঁটের গুঁড়ো, লাল সিঁদুর,ডিমের কুসুম,কাঠকয়লা,খড়িমাটি,আলতা ইত্যাদি আরো কত কিছুইনা ব্যবহার করা হয়। আরেকটু বললে...হলুদ রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় হলুদ কিংবা হলুদ গাছের শিকড় কে।একইভাবে, সবুজের জন্য সিমপাতা বা হিঞ্চে শাক, বেগুনীর জন্য জাম বা পাকা পুই মুচুরি, অপরিজিতা বা তুঁত থেকে নীল রং, কালো রঙের জন্য পোড়ামাটির গা থেকে চেঁছে নেওয়া হয় ভুষোকালি, অথবা গাব গাছের শিকড় পুড়িয়েও তৈরি হয় কালো রঙ, লালচে রং তৈরি করা হয় পোড়ামাটি বা লাল গিরিমাটি থেকে, এছাড়াও সজনে ডাটা কিংবা পাকা তেলাকুচা থেকেও লাল রং পাওয়া যায়, সেগুন গাছের পাতা দিয়ে মেরুন রং পাওয়া যায়, সাদা রঙের জন্য একধরনের বিশেষ মাটি ব্যবহার করা হয়, যার নাম হল কুসুম মাটি।
অন্যদিকে, তুলির জন্য পটুয়াদের ভরসা হলো পশুর লোম, পাখির লোম। যেমন বাচ্চা ছাগলের ঘাড়ের বা পেটের লোম তুলি হিসেবে ব্যবহার করেন তারা। আবার সরু তুলির জন্য কাঠবেড়ালির লোম কিংবা বেজির চুল ও ব্যবহার করা হয়। তবে, এখনকার পটুয়ারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাজার থেকে কেনা তুলিই ব্যবহার করে থাকেন।
বিষয়বৈচিত্র অনুসারে সংগৃহীত পটগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে;যেমন-চকসুদন পট, যমপট, সাহেবপট, কালিঘাটপট, গাজিপট, সত্যপীড়েরপট, পাবুজীপট, হিন্দুপ্রান পট ইত্যাদি।
তবে, পটশিল্প কিন্তু আজকের নয়। প্রায় ২০০০ সাল আগের। পৌরাণিক তথ্যের অনুসারে, এই পটুয়ারা হলেন বিশ্বকর্মার বংশধর। বৃহৎধর্ম পুরানে বিশ্বকর্মার নটি সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তানকে পটচিত্রকর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। জেনে রাখা ভালো যে, এই পটচিত্র বংশানুক্রমিক পেশা হিসেবে চলে আসছে। অর্থাৎ, এই শিল্পশৈলীর উত্তরাধিকার এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে বর্তায়।
পটচিত্র শিল্পী মামনি চিত্রকর বলেছেন ''আঁকা শুরু করার আগে আমাদের গানের পদগুলো তৈরি করে নিতে হয়…এই ছন্দটাই আঁকার প্রক্রিয়াতেও একটা ছন্দ যোগ করবে" অর্থাৎ আগেই বলা হয়েছে যে পটশিল্পীরা একাধারে যেমন শিল্পী আবার গায়ক ও বটে। প্রত্যেক পটের নেপথ্যে থাকে একটি কাহিনী, যেটি কিনা পটশিল্পীরা নিজেরা রচনা করে, গান গেয়ে সেটিকে বর্ণনা করেন। যেমন বলা যায়, পটুয়ারা পট প্রদর্শন এর সময় গান গেয়ে যখন মুড়িয়ে রাখা পট খোলা হয়, গানের এক একটি পদের সঙ্গে সঙ্গে দেখানো হয় সেই পদের বর্ণনাকারী পটের অংশটি।
পট এবং সংগীতের বিষয়বস্তু গড়ে ওঠে নানান পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে। যেমন - মহিষাসূরমর্দিনী, কমলে কামিনী, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা-চাঁদ সওদাগর, কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, চৈতন্যলীলা এ সবের উল্লেখ করা যায়। মরং বুরু, মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি ইত্যাদির কাহিনী সাঁওতাঁল সম্প্রদায়ের জন্য আঁকা হয়ে থাকে। হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবী, যেমন: দুর্গা, কালী, মনসা, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, যম, চন্ডী, দশ অবতার প্রভৃতি। কৈলাস, বৃন্দাবন, অযোধ্যা ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহও এতে মূর্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া জাদু, গাজী এবং হিতোপদেশমূলক চিত্রপটও অঙ্কিত হতে দেখা যায়। হিন্দুধর্মের শিব-পার্বতীলীলা, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণবধর্মের শ্রীগৌরাঙ্গলীলা ইত্যাদি পটের আকর্ষণীয় বিষয়। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী, যেমন: রামের বনবাস, সীতাহরণ, রাবণবধ, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদিও পটে অঙ্কিত হয়।
"পটে" মা দূর্গা (সোর্স : গুগল)
কিন্তু, বর্তমানে পটশিল্প কোথায়? প্রযুক্তির বাড় বাড়ন্তে আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক পটশিল্প। তবে,বর্তমানে পট শিল্প শুধু পটেই সীমাবদ্ধ নয়, যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে পটুয়ারা নিজের এবং নিজেদের শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজেদের শিল্প ছড়িয়ে দিয়েছে শাড়ি, ছাতা, জামা,ব্যাগ নানান রকমের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে, তারা ফুটিয়ে তুলেছে নিজেদের চিত্রকলা। কেবলমাত্র, হিন্দু দেব-দেবীদের কাহিনীতে নয় নানান সামাজিক ও বর্তমান পরিস্থিতির ঘটনাও তারা তুলে ধরছে পটের মাধ্যমে।
কিছু পটশিল্পী অর্থাৎ পটুয়ারা যেমন মামনি চিত্রকর, শম্ভু আচার্য, রঘুনাথ চক্রবর্তী, নিখিল চন্দ্র দাস প্রমুখরা এখনো আছেন যারা নিজের শিল্পকে কেন্দ্র করে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন এবং বাঁচাতে চাইছেন পটশিল্পকে। সেই জন্যেই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রাচীন চিত্রকলা ''পট শিল্প" চীন, জাপান,মালয়েশিয়া, আমেরিকা সহ আরো অনেক দেশে এ সুনাম অর্জন করছে। এইভাবেই শিল্পীদের শিল্পসত্ত্বার মাঝে এখনো জীবত রয়েছে "পট".
👀❤️
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Deletegood work 🙌🏻♥️
ReplyDeleteThank You ! ❤️
DeleteNice 👍❤️
ReplyDeleteThank You ! ❤️
DeleteNice
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Deletetry to post everyday this types of blogs
ReplyDeleteSure, Thank You ! ❤️
Deleteinformative
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Delete❤️❤️❤️
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Deleteভালো লিখেছিস 💗
ReplyDeleteধন্যবাদ ! 💐
Delete❤️
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Deleteসুন্দর লেখনী 💗
ReplyDeleteধন্যবাদ ! ❤️
Deleteপড়ে ভালো লাগলো ❤
ReplyDeleteধন্যবাদ ! ❤️
Deleteখুব সুন্দর লিখেছেন..❤️
ReplyDeleteধন্যবাদ ! ❤️
DeleteKhub sundor hoyeche ✨
ReplyDeleteThank You ! ❤️
DeleteNotun kichu jinis jana holo
ReplyDeleteThank You So Much ! 💗
Deleteভালো লিখেছিস সুসু 🧿
ReplyDeleteআরে, ধন্যবাদ ! ❤️
DeleteKihh sundor likhechish egiye jaa bhai
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Deletevai valo hoyeche re aro lekh pashe achi
ReplyDeleteThank You ! ❤️
DeleteI appreciate your work and research....
ReplyDeleteNice blog 🫶🏻. Good wishes 🤞🏻
Thank You ! ❤️ Keep supporting like this ✨✨
Deleteভালো তো ❤️
ReplyDeleteধন্যবাদ ! ❤️
DeleteWell structured and researched
ReplyDeleteThank You ! ❤️
DeleteQuiet impressive
ReplyDeleteThank You ! ❤️
Deleteঅনেক কিছুই জানতে পারলাম পরে বেশ ভালো লাগলো ❤️
ReplyDeleteধন্যবাদ ! ❤️🙏
DeleteThank You ! ❤️
ReplyDeleteSundar
ReplyDeleteThank You ! 🙏❤️
DeleteOneeek bhalo hoyechhe!♥️
ReplyDeleteGurudeb, pronam ❤️
Delete